মার্কস এর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ব টি আলোচনা করো।
কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা
সংজ্ঞা: মার্কসবাদের মূল ভিত্তি বা তত্ত্ব হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, যা বিশ্ববীক্ষা ও বস্তুবাদী দর্শনের স্বরূপ বলে বিবেচিত হয়। বস্তুবাদেরই রূপান্তর হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূলসূত্র গুলি (মানব সমাজের সৃষ্টি, বিকাশ, প্রসার, বৈপ্লবিক পরিবর্তন পদ্ধতি) প্রয়ােগ ঘটেছে। এমিল বার্নস-এর মতে, মানবসমাজ ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়ােগের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা হয়। স্তালিনের ভাষায়, সমাজ জীবনের অনুশীলনে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূলনীতি গুলির প্রয়ােগ ও ব্যবহারকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ("Historical materialism is the extension of principles of dialectical materialism to the study of social life”)। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কেবল অতীত ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা করে না, সেইসঙ্গে ভবিষ্যৎ সমাজের কাঠামাে কেমন হবে সে সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল বক্তব্য: কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালােচনা। কার্ল মার্কস তাঁর 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো নামক গ্রন্থে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, ইতিহাস কেবলমাত্র কতকগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংকলন বা কাহিনির বিন্যাস নয়। ইতিহাসের কোনাে ঘটনা অন্য ঘটনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইতিহাসের আলােচ্য বিষয় সমগ্র জনসাধারণ, কোনাে একক ব্যক্তি (বা রাজা, সম্রাট, শাসক) বিশেষ নয়। এই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল বক্তব্যগুলি নিম্নে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা হল一
[1] ভিত এবং উপরিকাঠামো: মার্কসবাদ অনুযায়ী অর্থনীতি হল সমাজের মূল ভিত (Basic structure) বা চালিকাশক্তি। এই অর্থনৈতিক ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা, ধর্ম সাহিত্য, কলা ইত্যাদি সামাজিক উপরিকাঠামােগুলি (Super structures)। মার্কসবাদ অনুযায়ী মূল অর্থনৈতিক কাঠামাের মধ্যে পরিবর্তন এলেই উপরিকাঠামো পরিবর্তন আসবে।
[2] মানুষের প্রাথমিক চাহিদা: কার্ল মার্কসের মতে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, উৎপাদনের উপকরণ প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা। বাঁচার তাগিদেই মানুষকে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে হয়। তিনি আরও বলেছেন যে, উৎপাদনের উপায় এবং পদ্ধতির উপরে মানুষের বৈষয়িক জীবনযাত্রা নির্ভর করে। মানবসমাজের মৌলিক পরিবর্তনের মূল কারণ হল উৎপাদন পদ্ধতিতে তার ভূমিকা। তিনি দেখিয়েছেন যে, উৎপাদন পদ্ধতি (বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা) হল সমস্ত কিছুর মূল চালিকাশক্তি।
[3] উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক: উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক বর্তমান যথা一
- উৎপাদন শক্তি: শ্রমিক ও তার দক্ষতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিকে বলা হয় উৎপাদন শক্তি।
- উৎপাদন সম্পর্ক: উৎপাদন ব্যবস্থায় মানুষের সঙ্গে মানুষের অর্থাৎ শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির, শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের এবং শ্রমিক যে য্ত্রের সাহায্যে উৎপাদন করে সেই যন্ত্রের প্রতি শ্রমিকের ভালােবাসার মধ্য দিয়ে উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
[4] উৎপাদন ব্যবস্থার ভারসাম্য: কার্ল মার্কস বলতে চেয়েছেন যে, উৎপাদন শক্তির মধ্যে পরিবর্তন এলে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেও পরিবর্তন আসবে। অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে যদি সুসংগতি বা ভারসাম্য বাজায় থাকে তাহলে আদর্শ অর্থাৎ শােষণহীন উৎপাদন ব্যবস্থা এবং শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
[5] সमाজ পরিবর্তনের কারণ: কার্ল মার্কসের মতে, উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক -এই দুই উৎপাদন পদ্ধতির দ্বন্দ্বেই সমাজ পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কস বলেছেন, আদিম সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদনের উপর কোনাে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না তাই শ্রেণিভেদ বা শ্রেণিশােষণ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে দাস সমাজে দাস মালিকরা উৎপাদনের উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি করে তারপর কালক্রমে বিপ্লব বা বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রথমে সামন্তপ্রভু এবং পরে পুঁজিপতি দের হাতে তা চলে আসে। এই সময়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন পদ্ধতির দুটি অংশের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ চলতেই থাকে। এইভাবে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন ঘটে।
[6] ইতিহাসের গতিবিধি: আদিম সাম্যবাদী সমাজে সহজসরল উৎপাদিকা শক্তির ফলে উৎপাদন সম্পর্ক শােষণহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু মার্কস দেখিয়েছেন যে, কোনাে উৎপাদন ব্যবস্থাই দীর্ঘকাল এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে না, তা ক্রমশ উন্নতির দিকে এগিয়ে চলে। মানব ইতিহাসে প্রথম উৎপাদনমূলক এবং শােষণমুলক সমাজ দেখা যায় দাস সমাজে। এই সমাজে দাস প্রভুরা সব কিছুর মালিক, দাসরা কেবল উৎপাদনকারী বিনিময়ে লাভ করে সামান্য মজুরি। একদিন শোষণ-বঞ্চনার কারণে সেই সমাজ পরিবর্তিত হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। এই সমাজে সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাসদের শােষণ করে, তারপর ধনতান্ত্রিক সমাজের শ্রমিককে বা সর্বহারা শ্রেণিকে পুঁজিপতি মালিকরা শােষণ করে, শুরু হয় শ্রেণিদ্বন্দ। এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে পত্তন হয় নতুন সমাজ ব্যবস্থার। এইভাবে ক্রমবিবর্তনের পথে দাস সমাজ থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত হয় ধনতান্ত্রিক সমাজ এবং রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজ।
এই স্তরের পরে প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের ধারক শ্রেণি নতুন উৎপাদন শক্তির বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন বিনা বাধায় সাধিত হয় না। পুরােনাে সম্পর্ককে বাতিল করার জন্য প্রয়ােজন হয় নতুন প্রগতিশীল মতাদর্শ। এইভাবে আদিম সমভােগবাদী সমাজ থেকে শুরু করে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
সমালােচনা: পশ্চিমি তাত্ত্বিকগণ মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তত্ত্বকে বিভিন্নভাবে সমালােচনা করেছেন।
প্রথমত: রেমন্ড আরো, ড্যানিয়েল বেল প্রমুখের মতে, উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ইতিহাসের অগ্রগতি ঘটেনি, তা ঘটেছে এককভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ফলে।
দ্বিতীয়ত: উইলিয়াম, জি এ কোহেন প্রমুখের মতে, এই তত্ত্বটি ঐতিহাসিক নিয়তিবাদ, যার অর্থ ইতিহাসের অমােঘ নিয়মে সব কিছু নির্ধারিত হচ্ছে। মানুষের কিছু করার নেই।
তৃতীয়ত: গর্ডন লেফ-এর মতে, উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক বলেই সেখানে কোনাে তত্ত্বগত পার্থক্য নেই।
চতুর্থত: কার্ল পপার, মেলো প্রমুখের মতে, ইতিহাসের অর্থ বলে কিছু হয় না, তাই সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে কোনো ঐতিহাসিক নিয়ম প্রয়ােগ করা যায় না।
উপসংহার: উপরোস্ত সমালােচনা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ইতিহাসের সব ঘটনার পশ্চাতে কোনাে-না-কোনাে ভাবে অর্থনীতি প্রভাববিস্তার করেছে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কেবল একটি তত্ত্ব নয়, এটি হল প্রয়ােগ দর্শন। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মার্কসের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। তাই পরিশেষে বলা যায়, মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিশ্লেষণের সত্যতা ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
Comments
Post a Comment